প্রধান উপদেষ্টার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব
প্রধান উপদেষ্টার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব
admin
প্রকাশিত November 4, 2025, 02:10 AM
প্রধান উপদেষ্টার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব
অদিতি করিম
প্রধান উপদেষ্টা যে দূরদর্শী একজন সত্যিকারের অভিভাবক তার প্রমাণ আবারও দিলেন। গণভোট, জুলাই সনদ, পিআর পদ্ধতি এবং আরপিও সংশোধন নিয়ে যখন রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত; তারা যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে সোচ্চার; একে অন্যের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত; যখন দেশের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা এবং অনিশ্চয়তার কালো মেঘ; নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে কি না তা নিয়ে জনমনে সংশয়; দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে; কেউ সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না; এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সবাই তাকিয়ে ছিলেন জাতির অভিভাবক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে। গতকাল সকালে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোট নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট নিরসনে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক ডাকেন। এ বৈঠকে তাঁর নেতৃত্বে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তা তাৎপর্যপূর্ণ। গণতন্ত্রে উত্তরণে এ সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্তসংক্রান্ত বিবৃতিতে বলা হয়-
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রণীত জুলাই সনদ এবং এর বাস্তবায়নসংক্রান্ত বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদের একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপনের প্রচেষ্টার জন্য এবং বহু বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ঐকমত্য কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ চূড়ান্তকরণ এবং এতে উল্লিখিত গণভোট আয়োজন ও গণভোটের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয়। এতে লক্ষ করা হয় যে ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘদিন আলোচনার পরও কয়েকটি সংস্কারের সুপারিশ বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। এ ছাড়া গণভোট কবে হবে ও এর বিষয়বস্তু কী হবে, এসব প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে সেজন্য সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে গণভোটের সময় কখন হবে, গণভোটের বিষয়বস্তু কী হবে, জুলাই সনদে বর্ণিত ভিন্নমতগুলো প্রসঙ্গে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলোর আলোকে জরুরি ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে সভা অভিমত ব্যক্ত করে।
এসব ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিনের মিত্র দলগুলোকে স্বীয় উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে (সম্ভব হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে) সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা প্রদান করার আহ্বান জানানো হয়। এমন নির্দেশনা পেলে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সহজ হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কালক্ষেপণের যে কোনো সুযোগ নেই, তা-ও আমাদের সবার বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। সভায় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্থে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করা হয়। এ সিদ্ধান্তের গুরুত্ব বহুমাত্রিক।
প্রথমত এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন। জুলাই সনদ, গণভোট ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের বিষয়। কাজেই তাদেরই ঠিক করতে হবে তারা কোন পথে যাবে। সরকার দলগুলোকে জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে ভুল করেছিল, সেটা শুধরে নেওয়ার সুযোগ করে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। ঐকমত্য কমিশন যদি প্রথমে নিজেরা সংস্কারের ডালি খুলে না বসে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলত কোন কোন বিষয়ে তারা সংস্কার চায়, তা আলোচনা করে সমাধান করতে, তাহলে এ অনৈক্য আর বিভাজন সৃষ্টি হতো না। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের কারও কারও অতি উৎসাহ এবং সবকিছু চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা আজকের সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংকট নিরসনে ড. ইউনূস সঠিক পথই বেছে নিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা রেখেছেন। দলগুলো অতীতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বহু ইস্যুতে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই তাদের সমস্যা তারাই সবচেয়ে ভালো সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে।
তৃতীয়ত রাজনৈতিক দলের ওপর সুশীলদের খবরদারি বন্ধ করতে এ সিদ্ধান্ত হবে একটি মাইলফলক। সুশীলদের চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়, বরং রাজনৈতিক দলের ভিতর থেকেই সমাধান বেরিয়ে আসতে হবে। এ সত্যটা ড. ইউনূস হাতেকলমে করে দেখালেন।
চতুর্থত ড. ইউনূস খুব ভালো করেই জানেন রাজনৈতিক বিভাজন যদি বাড়তে থাকে তাহলে শুধু নির্বাচন অনিশ্চিত হবে না, ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন ঘটবে। জুলাই বিপ্লবের সব অর্জন মুছে যাবে। এজন্য তিনি এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনের শক্তিগুলোকে আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এটা সফল হলে রাজনীতিতে আবার সুস্থ ও সৌহার্দের পরিবেশ ফিরে আসবে।
সবশেষে প্রধান উপদেষ্টা জনগণের ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করলেন। এ আলোচনার মাধ্যমে জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব বুঝতে পারবে। আগামী নির্বাচনে জনগণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হলো প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্তের ফলে।
জনগণের উৎকণ্ঠা এবং আবেগ আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো অনুধাবন করতে পারবে। দলের চেয়ে দেশের এবং জনগণের স্বার্থে তারা নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনবে। গণতন্ত্রে উত্তরণে তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে বলেই দেশবাসী আশা করে।