সিলেট [english_date], [bangla_date], [hijri_date]

‘সবচেয়ে ভাগ্যবান হলেও তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছি’- এয়ার ইন্ডিয়ার বিধ্বস্ত বিমানের একমাত্র জীবিত যাত্রী

প্রকাশিত November 4, 2025, 12:49 PM
‘সবচেয়ে ভাগ্যবান হলেও তীব্র যন্ত্রণায় ভুগছি’- এয়ার ইন্ডিয়ার বিধ্বস্ত বিমানের একমাত্র জীবিত যাত্রী

Spread the love

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ওই বিমানে সওয়ার ২৪১ জনের, বেঁচে গিয়েছিলেন মাত্র একজন। তার নাম বিশোয়াস কুমার রমেশ।

এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নিজেকে “বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি” হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও তীব্র শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা এখনো পিছু ছাড়েনি তার।

গুজরাতের আমেদাবাদে চলতি বছরের জুন মাসে বিধ্বস্ত হয় ওই লন্ডনগামী বিমান। বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত বেরিয়ে আসা বিশোয়াস কুমার রমেশের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ্যে আসে। মুহূর্তে বিশ্বেজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি।

এয়ার ইন্ডিয়া বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় একমাত্র জীবিত যাত্রী বিবিসিকে বলেছেন, বেঁচে যাওয়াটা নিতান্তই ‘অলৌকিক’ ছিল। একইসঙ্গে এও জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় নিজে বেঁচে ফিরলেও কীভাবে সব কিছু হারিয়েছেন তিনি।

এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমানে তার ছোট ভাই অজয়ও ছিলেন। কিছুটা দূরের আসনে বসা ছোট ভাই রেহাই পাননি। চলতি বছরের জুন মাসের ওই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল তার ভাই অজয়ের।

পরামর্শদাতারা জানিয়েছেন, ইংল্যান্ডের লেস্টারে ফেরার পর থেকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর সঙ্গে লড়ছেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। স্ত্রী এবং বছর চারেকের ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না তিনি।গুজরাতের আহমেদাবাদ থেকে উড়ান শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয় বোয়িং ৭৮৭। ঘটনার পর পরই প্রকাশ্যে আসা এক ভিডিওতে দেখা যায় বিধ্বস্ত হওয়া ওই বিমানের ধ্বংসাবশেষ হেঁটে বেরিয়ে আসছেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। তার পিছনে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া।

‘অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কম কিছু নয়’

বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বেশ কয়েকবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন মি. কুমার।

তিনি বলছিলেন, “একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। আমি এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারি না। এটা কোনো অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কম কিছু নয়”।

“আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি। ভাই ছিল আমার শক্তি। গত কয়েক বছর ধরে সেই ছিল আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্টার (সমর্থক)”।

এই ঘটনা কীভাবে তার এবং তার পরিবারের জীবন পুরোপুরি বদলে দিয়েছে, তা জানিয়েছেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক, যার মাতৃভাষা গুজরাতি।

তার কথায়, “এখন আমি একা। নিজের রুমে চুপচাপ একলা বসে থাকি। আমি আমার স্ত্রী বা ছেলের সঙ্গে কথা বলি না। আমি এখন একা থাকতেই পছন্দ করি”।

হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় থেকে তিনি বর্ণনা করেছিলেন ঘটনার দিন কীভাবে নিজের সিটবেল্ট খুলে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এয়ার ইন্ডিয়ার লন্ডনগামী বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় যাত্রী এবং বিমানের ক্র্যু মিলিয়ে ১৬৯ জন ভারতীয় এবং ৫২ জন ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। ওই বিমান ভেঙে পড়ে ঘটনাস্থল ও সে সময় তার কাছাকাছি থাকা ১৯ জনের প্রাণও কেড়েছিল।

চলতি মাসের জুলাই মাসে ভারতের ‘এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ (এসিআইবি) তার প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, উড়ান শুরু করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিমানের ইঞ্জিনের জ্বালানি সরবরাহ কাট-অফ (সুইচ) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখনো ঘটনার তদন্ত চলছে।

এদিকে, এয়ার ইন্ডিয়ার তরফে বলা হয়েছে, বিশোয়াস কুমার রমেশ এবং এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত পরিবারের যত্ন নেওয়া “আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার”।

বছর ৩৯-এর বিশোয়াস কুমার রমেশ যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার পর এই প্রথম গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার সঙ্গে কথোপকথনের জন্য বেশ কিছু সংবাদ সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তথ্যচিত্র তৈরি করার জন্য টিমও একটা ঘরে শ্যুটিং করছিল।

মি. রমেশের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে বিবিসি নিউজ তার পরামর্শদাতাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিল।

ঘটনার দিনের স্মৃতির বিষয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “আমি এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।”

‘আমি কষ্টে আছি’

লেসটারে স্থানীয় কমিউনিটি নেতা সঞ্জীব প্যাটেল এবং তার পরিবারের মুখপাত্র রাড সিগারের পাশে বসে বসে কথা বলছিলেন মি. কুমার। তিনি জানিয়েছেন, ওই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি হাতড়ে দেখা তার পক্ষে কঠিন।

মি. প্যাটেলের বাড়িতে বসে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বেশ কয়েকবার ভেঙে পড়েছেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলেন না তিনি।

ঘটনার পর তার এবং তার পরিবার যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কে জানিয়েছেন মি. রমেশ।

তার কথায়, “এই দুর্ঘটনার পর…আমার জন্য পরিস্থিতি খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছে।”

“শারীরিক ও মানসিকভাবে আমার জীবন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমার পরিবারও মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত… আমার মা গত চার মাস ধরে প্রতিদিন দরজার বাইরে বসে থাকেন, কারও সঙ্গে কথা বলেন না… কিচ্ছু না”।

নিজের মানসিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বিশোয়াস কুমার রমেশ উল্লেখ করেছেন, “আমিও কারও সঙ্গে কথা বলি না। কারও কথা সঙ্গে বলতে ইচ্ছেও করে না”।

যে ওই ঘটনায় বিমানে সওয়ারদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ব্যক্তির কথায়, “বেশি কিছু বলতে পারি না। সারারাত ভাবতে থাকি নিয়ে, মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমি”।

“প্রতিটা দিনই আমার পুরো পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক”।

“আমি ঠিকমতো হাঁটতেও পারি না”।

ওই ঘটনায় তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন সে সম্পর্কে জানিয়েছেন মি. রমেশ। তিনি জানিয়েছেন তার আসন ১১-এ থেকে বিমানের ভাঙা অংশ দিয়ে কোনোমতে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন।

তিনি বলেন, “আমার পা, কাঁধ, হাঁটু ও পিঠে এখনো ব্যথা হয়। দুর্ঘটনার পর থেকে আমি কাজ করতে পারছি না, গাড়ি চালাতেও পারছি না। যখন আমি চলার চেষ্টা করি তখন ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। আমি আস্তে আস্তে হাঁটি, আমাকে আমার স্ত্রী (চলতে) সাহায্য করেন”।

ভারতে চিকিৎসা চলাকালীন চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন, বিশোয়াস কুমার রমেশ পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর সঙ্গে লড়ছেন। কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে আসার পর থেকে তিনি কোনো চিকিৎসা পাননি বলেই জানিয়েছেন মি. রমেশের পরামর্শদাতারা।

তারা জানিয়েছেন, ঘটনার পর একেবারে ভেঙে পড়েছেন বিশোয়াস কুমার রমেশ। সেরে ওঠার জন্য তাকে পথ দীর্ঘ চলতে হবে। ওই পরামর্শদাতাদের অভিযোগ, ঘটনার পর এয়ার ইন্ডিয়া তাদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করেনি। তাই তারা ওই বিমান সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের দাবি জানিয়েছেন।

কমিউনিটি নেতা সঞ্জীব প্যাটেল বিবিসিকে বলেছেন, “ওরা মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। (এই ঘটনা) ওদের পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে”।

“এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের এগিয়ে আসতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তাদের কী প্রয়োজন বুঝতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে”।

সমবেত প্রচেষ্টার আহ্বান

এয়ার ইন্ডিয়া বিশোয়াস কুমার রমেশকে অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২১ হাজার ৫০০ পাউন্ড (ভারতীয় টাকার হিসাবে প্রায় ২৫ লাখ টাকা) দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা তিনি গ্রহণ করেছেন। তবে তার পরামর্শদাতারা জানিয়েছেন যে অঙ্কটা তার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

তারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার আগে বিশোয়াস কুমার ও তার ভাই অজয় ভারতের দিউতে মাছের ব্যবসা চালাতেন, যা এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

পরিবারের মুখপাত্র রাড সিগার জানিয়েছেন, এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে বৈঠকের জন্য তারা তিনবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তাদের হয় “উপেক্ষা করা হয়েছিল বা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল”।

তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমে এই সাক্ষাৎকারগুলোর মাধ্যমে তারা আসলে চতুর্থবার এয়ারলাইন্সের কাছে আবেদন জানাতে চান।

মি. সিগারের কথায়, “এটা খুবই দুঃখজনক যে আজ আমাদের এখানে এইভাবে বসতে হচ্ছে এবং ওকের (বিশোয়াস কুমার রমেশকে) এর মধ্যে (মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিচারণার বিষয়ে ইঙ্গিত করে) দিয়ে যেতে হচ্ছে”।

“এখানে যাদের থাকা উচিত ছিল, তারা হলেন এয়ার ইন্ডিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তা। তাদের উচিত ছিল পরিস্থিতি যাতে বদলায় তার ব্যবস্থা করা”।

তিনি আবেদন জানিয়ে বলেছেন, “প্লিজ আমাদের সঙ্গে বসুন, কথা বলুন যাতে এই যন্ত্রণা একটু হলেও কমানোর উদ্দেশ্যে আমরা সমবেতভাবে কিছু করতে পারি”।

টাটা গ্রুপের মালিকানাধীন এয়ার ইন্ডিয়ার তরফে অবশ্য এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, তাদের শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করছেন এবং গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন”।

ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “বিশোয়াস কুমার রমেশের প্রতিনিধিদের কাছেও এই জাতীয় বৈঠকের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব এবং ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার আশা রাখব”।

এয়ার ইন্ডিয়া বিবিসিকে জানিয়েছে, সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগেই তাদের তরফে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

Spread the love

Leave a Reply Cancel reply