সিলেট [english_date], [bangla_date], [hijri_date]

রাজনৈতিক বি রো ধে চট্টগ্রামে ১৩ মাসে ১৫ জন খু ন

admin
প্রকাশিত November 7, 2025, 05:06 AM
রাজনৈতিক বি রো ধে চট্টগ্রামে ১৩ মাসে ১৫ জন খু ন

রাজনৈতিক বি রো ধে চট্টগ্রামে ১৩ মাসে ১৫ জন খু ন

বিএনপি নেতার গণসংযোগের সময় ভিড়ের মধ্যে সরোয়ারের ঘাড়ে পিস্তল তাক করছেন কেউ একজন। গুলিতে ঘটনাস্থলেই সরোয়ারের মৃত্যু হয়
বিএনপি নেতার গণসংযোগের সময় ভিড়ের মধ্যে সরোয়ারের ঘাড়ে পিস্তল তাক করছেন কেউ একজন। গুলিতে ঘটনাস্থলেই সরোয়ারের মৃত্যু হয়ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

রাজনৈতিক বিরোধে চট্টগ্রামে গত ১৩ মাসে খুন হয়েছেন ১৫ জন। এর মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই ১০ জন খুন হয়েছেন। রাজনৈতিক বিরোধের পাশাপাশি বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বেও চট্টগ্রামে খুনোখুনির ঘটনা বেড়েছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এমন পরিস্থিতিতে শঙ্কিত বিএনপির স্থানীয় নেতারাও। বিশেষ করে নির্বাচনী জনসংযোগের সময় বিএনপির প্রার্থীর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। চট্টগ্রামের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতকারীরা আবার দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে।

গত বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের যে এলাকায় (চালিতাতলী) বিএনপির প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হন, সেই একই এলাকায় গতকাল দুপুরে ইদ্রিস আলী নামের এক রিকশাচালককে হাঁটুতে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

এর আগে বুধবার সন্ধ্যার ওই ঘটনার পর রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার বাগোয়ান এলাকায় বিএনপির দুই পক্ষে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ তিনজন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বাকি দুজন দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (এখন পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী।

বুধবার রাতের গোলাগুলির বিষয়ে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গোলাম আকবর খন্দকারের সঙ্গে গতকাল রাতে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা এই ঘটনার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেন। গিয়াস কাদের বলেন, গোলাম আকবর এসব ঘটনায় জড়িত। অন্যদিকে গোলাম আকবর বলেন, গিয়াসের অনুসারীরা জড়িত।

গত ১৩ মাসে চট্টগ্রামে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যে ১০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, তার ৭টিই হয়েছে রাউজানে।

রাউজানেই ৭ খুন

গত ১৩ মাসে চট্টগ্রামে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যে ১০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, তার ৭টিই হয়েছে রাউজানে। রাউজানে যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁরা হলেন আলমগীর আলম, আবদুল হাকিম, কমর উদ্দিন, মো. ইব্রাহিম, মানিক আবদুল্লাহ, মুহাম্মদ সেলিম ও দিদারুল আলম। তাঁদের কেউ গিয়াস কাদেরের অনুসারী, কেউ গোলাম আকবরের অনুসারী।

এ ছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গত মার্চে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন মো. জাবেদ নামের এক কর্মী। তিনি মিরসরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নুরুল আমিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম শহরের বাকলিয়া এলাকায় দুই পক্ষের গোলাগুলিতে মো. সাজ্জাদ নামে ছাত্রদলের এক কর্মী খুন হন। সাজ্জাদ চট্টগ্রাম নগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হকের অনুসারী। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এমদাদুল ও চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহর অনুসারীদের মধ্যে এই গোলাগুলি হয় বলে পুলিশ জানায়।

এর বাইরে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী এলাকায় ব্যানার টাঙানো নিয়ে গত ২১ মার্চ সংঘর্ষের সময় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৩ এপ্রিল মো. জিহাদ নামে যুবদলের এক কর্মী মারা যান। চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের সদস্যসচিব শরীফুল ইসলামের অনুসারীদের সঙ্গে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা শাহ আলমের অনুসারীদের ওই সংঘর্ষ হয়। জিহাদ শাহ আলমের অনুসারী ছিলেন।

এর বাইরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পাঁচ কর্মী খুন হয়েছেন গত ১৩ মাসে। এই পাঁচজনই রাউজানে খুন হয়েছেন।

দলীয় প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পেছনে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ কাজ করেনি বলে জানান বিএনপির স্থানীয় নেতারা। তাঁরা বলছেন, এই ঘটনা দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ঘটেছে। তবে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার গভীর ষড়যন্ত্র এর পেছনে কাজ করতে পারে বলেও মনে করেন তাঁরা।

বিএনপির প্রার্থীকে গুলি, তদন্ত চলছে

বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচনী জনসংযোগে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রার্থী ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহসহ পাঁচজন। এই পাঁচজনের মধ্যে গুলিতে নিহত হন সরোয়ার হোসেন। পুলিশ বলছে, তাঁর বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। তিনি গত বছরের ৫ আগস্টের পর জামিনে বের হন।

সরোয়ার বিএনপির বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে অংশ নিতেন। পরিবার বলছে, সরোয়ার যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে কোনো পদে ছিলেন না।

তবে বিএনপি ও যুবদলের নেতারা বলছেন, সরোয়ার তাঁদের কর্মী নন। মিছিল-সমাবেশে অনেকেই অংশ নেয়।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের করা সন্ত্রাসীদের তালিকায় সরোয়ারের নাম রয়েছে। তাঁকে খুন করার পেছনে রাজনৈতিক বিরোধ কাজ করেছে কি না, সেটি তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

দলীয় প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পেছনে কোনো রাজনৈতিক বিরোধ কাজ করেনি বলে জানান বিএনপির স্থানীয় নেতারা। তাঁরা বলছেন, এই ঘটনা দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে ঘটেছে। তবে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার গভীর ষড়যন্ত্র এর পেছনে কাজ করতে পারে বলেও মনে করেন তাঁরা।

ফেসবুকে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সরোয়ার

বিএনপি নেতাদের সঙ্গে এবং দলটির মিছিল-সমাবেশে অংশ নেওয়ার ছবি–ভিডিও ফেসবুকে দিতেন সরোয়ার। বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান ও এরশাদ উল্লাহর বিভিন্ন সমাবেশে সরোয়ারের যোগ দেওয়ার ছবি ও ভিডিও রয়েছে। যদিও এখন নেতারা বলছেন, সরোয়ার বিএনপির কেউ নন।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শওকত আজম খাজা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামনে আমরা সতর্ক থাকব, যাতে কোনো সন্ত্রাসী মিছিল-সমাবেশে ঢুকে যেতে না পারে।’

চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও, বায়েজিদ বোস্তামী ও পাঁচলাইশ এবং জেলার হাটহাজারী, রাউজানসহ পাঁচ থানার পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে সাজ্জাদের বাহিনীর কারণে আতঙ্কে থাকতে হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত ১০টি খুনের ঘটনায় সাজ্জাদের নাম এসেছে।

সরোয়ারের সঙ্গে আরেক সন্ত্রাসীর বিরোধ

গুলিতে নিহত সরোয়ার চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলীর (এখন বিদেশে পলাতক) শিষ্য ছিলেন একসময়। পরে সাজ্জাদের সঙ্গে সরোয়ারের বিরোধ তৈরি হয়। এই বিরোধ থেকেই সরোয়ারকে খুনের পরিকল্পনা করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। সরোয়ার খুন হওয়ার পর তাঁর পরিবারও একই কথা বলছে।

চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও, বায়েজিদ বোস্তামী ও পাঁচলাইশ এবং জেলার হাটহাজারী, রাউজানসহ পাঁচ থানার পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে সাজ্জাদের বাহিনীর কারণে আতঙ্কে থাকতে হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত ১০টি খুনের ঘটনায় সাজ্জাদের নাম এসেছে।

পুলিশ জানায়, সাজ্জাদের বাহিনীতে অন্তত ২৫ জন সক্রিয় রয়েছেন। মূল নেতৃত্বে রয়েছেন ১৭ মামলার আসামি, বর্তমানে কারাগারে থাকা ছোট সাজ্জাদ। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর ১৫ মামলার আসামি রায়হান নেতৃত্বে আসেন।

এর আগে গত বছরের ২৯ আগস্ট খুন হন সরোয়ারের সহযোগী মো. আনিস ও কায়সার।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে অপরাধীরা একের পর এক প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারতে দ্বিধা করছে না। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করা না গেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী

জামিনে বেরিয়ে বেপরোয়া সন্ত্রাসীরা

পুলিশ ও কারা সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ, সরোয়ার, রায়হান, মোবারক হোসেন, খোরশেদ আলম, শহীদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা, ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পু, ইদ্রিস, ইয়াসিন, শিবু, রাকিব, সবুজ, নাছির উদ্দীনসহ অন্তত ৩৫ জন ‘সন্ত্রাসী’ জামিনে বেরিয়ে আসেন। তাঁরা আবার জড়িয়ে পড়েন অপরাধে। এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ৫টি থেকে ২০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে।

এই সন্ত্রাসীদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন, যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অন্তত ৩৫ জন ‘সন্ত্রাসী’ জামিনে বেরিয়ে আসেন। তাঁরা আবার জড়িয়ে পড়েন অপরাধে। এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ৫টি থেকে ২০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে।

খুনোখুনির ঘটনা বাড়ছে

গত বছরের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের আটটি থানা ও আটটি ফাঁড়ি থেকে ৯৪৫টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৭৮০টি অস্ত্র। যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়নি, সেসব অস্ত্র বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম শহরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালানো ৪৬ অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করেছিল পুলিশ। এর মধ্যে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিরা পলাতক। ওই অস্ত্রধারীরা গ্রেপ্তার না হওয়া আইনশৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ও জেলায় খুন হয়েছেন ৩৫ জন। এর মধ্যে গুলিতেই খুন হন ২২ জন। বাকিদের পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে অপরাধীরা একের পর এক প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারতে দ্বিধা করছে না। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করা না গেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে।