শীতার্তের পাশে থাকুক মানবতার হাত
মুফতি উবায়দুল হক খান
শীত প্রকৃতির এক অনিবার্য ঋতু। এর সৌন্দর্য, শীতলতা ও প্রশান্তির মধ্যেও লুকিয়ে থাকে জীবনের কঠোরতম বাস্তবতা। শীত যখন ধনী-সুবিধাভোগীর কাছে আরামের ঋতু, তখনই এটি দরিদ্র, অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য হয়ে ওঠে আতঙ্ক, কষ্ট আর সংগ্রামের নাম। রাতের হিমেল বাতাস, কনকনে শীতলতা, উষ্ণতার অভাব আর পোশাক-আশ্রয়ের সংকট—সব মিলিয়ে শীতার্ত মানুষের জীবন হয়ে ওঠে এক নির্মম লড়াই।
এমন বাস্তব সময়ে মানবতার হাতই পারে শীতার্তদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুর্ভোগ কমাতে। তাই আজকের সমাজে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো শীতার্তের পাশে মানবতার হাত প্রসারিত করা।
শীত—বঞ্চিত মানুষের বাস্তবতা
আমাদের সমাজে হাজারো মানুষ আছে, যারা প্রতিদিনের অন্নের সন্ধানে ব্যস্ত; শীতবস্ত্র, কম্বল বা আশ্রয় তাদের কাছে বিলাসিতার নাম। ফুটপাতের শ্রমজীবী মানুষ, রিকশাচালক, দিনমজুর, পথশিশু, বৃদ্ধ-বিধবা, বস্তিবাসী—এদের অনেকেরই শরীরে থাকে শুধু একটি পাতলা কাপড়।
রাতের গভীরে যখন শীত নেমে আসে, তখন উষ্ণ ঘরে শীত উপভোগের সুযোগ তাদের নেই। অনেকেই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, নিউমোনিয়া, সর্দিকাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হয়। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট এই ঋতুতে সবচেয়ে বেশি। শীতার্ত মানুষের কষ্ট শুধু শারীরিক নয়, তা মানসিকভাবেও অসহনীয়।
সমাজের প্রাচুর্যের মধ্যেও তারা বঞ্চিত থাকে ন্যূনতম মানবিক সহায়তা থেকে। এই বঞ্চনা আমাদের মানবতার মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
মানবতার প্রকৃত রূপ
মানবতা শুধু কথার বিষয় নয়, এটি কর্মের প্রকাশ। মানুষের প্রতি মানুষের হৃদ্যতা, সহমর্মিতা, সাহায্য-সহযোগিতা ও দায়বদ্ধতাই মানবতার প্রকৃত রূপ। যখন সমাজে কেউ কষ্টে থাকে, আর অন্য কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই কষ্ট লাঘব করে—সেখানেই মানবতা আলোকিত হয়।
শীতার্তের পাশে দাঁড়ানো শুধু দান নয়; এটি মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব, নৈতিকতা এবং সভ্যতার পরিচয়। মানবতা ধর্ম, বর্ণ, অবস্থান বা শ্রেণিভেদ মানে না। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সমাজ হয়ে ওঠে উষ্ণ, হৃদয়বান ও মানবিক। একটি কম্বল, একটি সোয়েটার বা এক কাপ গরম খাবার, যা কারো কাছে তুচ্ছ মনে হতে পারে তা অন্য কারো জীবনে বড় আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। এটাই মানবতার সৌন্দর্য।
ধর্মীয় ও নৈতিক প্রেরণা
বিশ্বের সব ধর্মই মানবতার শিক্ষা দেয়। ইসলাম দান, সহযোগিতা ও অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে ইবাদত হিসেবে দেখিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানবকল্যাণে কাজ করে, সে আল্লাহর প্রিয়।’ একইভাবে অন্য ধর্মেও মানবসেবাকে সর্বোচ্চ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সুতরাং, শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো শুধু সামাজিক কর্তব্য নয়, এটি আধ্যাত্মিক উন্নতির পথও বটে।
নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেও সমাজে বঞ্চিত মানুষের কষ্ট লাঘব করা এক অনন্য দায়িত্ব। যে সমাজে সবাই একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়, সেই সমাজই অগ্রসর, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ। তাই মানবতার হাত প্রসারিত করা মানে সমাজের ভবিষ্যৎ সুন্দর করা।
সমাজ, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান—সবার যৌথ দায়িত্ব
শীতার্তদের কষ্ট লাঘবে একা কারো উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা—ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা—সবার আন্তরিক সহযোগিতা।
ব্যক্তিগত উদ্যোগ : যে যা পারে, তা দিয়েই শুরু করা যায়। আলমারিতে পড়ে থাকা অতিরিক্ত শীতবস্ত্র, কম্বল, জ্যাকেট, উলের পোশাক—এসব দান করলেই কত মানুষের মুখে হাসি ফোটে। একটি পরিবার যদি বছরে অন্তত কয়েকটি কম্বল দান করে, তাহলে হাজারো পরিবার মিলে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব।
সামাজিক ও যুব সংগঠন : স্থানীয় যুবসমাজ শীতবস্ত্র সংগ্রহ অভিযান, তহবিল সংগ্রহ, দরিদ্রদের তালিকা তৈরি, বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। তাদের সক্রিয়তা সমাজে মানবতার জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে।
প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন : করপোরেট প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, মসজিদ কমিটি—সবাই মিলে শীতবস্ত্র বিতরণ, চিকিৎসা সহায়তা ও আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ : সরকারি পর্যায়ে ত্রাণ সহায়তা এবং শীতার্ত এলাকায় জরুরি সেবা প্রদান সমাজের জন্য অপরিহার্য। বরাদ্দ বৃদ্ধি, কার্যকর বণ্টন ও নজরদারি হলে শীতার্ত মানুষের কষ্ট অনেকটাই কমে।
মানবতার হাত প্রসারিত করলে কী বদলাবে
এক. জীবন রক্ষা হবে—একটি কম্বল কারো জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা হতে পারে।
দুই. রোগ-ব্যাধি কমবে—উষ্ণতায় শীতজনিত রোগ কমবে।
তিন. সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হবে—মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বাড়বে।
চার. মানসিক শান্তি আসবে—দান ও সহযোগিতা মানুষের হৃদয়ে প্রশান্তি আনে।
পাঁচ. দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে—অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয়ে মানবতার কাজে যুক্ত হবে।
আমাদের করণীয়
শীত শুরু হওয়ার আগেই শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও প্রস্তুতি নেওয়া। অবহেলিত অঞ্চল, গ্রামের অসহায় মানুষের খোঁজ নেওয়া। পথশিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়া। ব্যবহৃত কাপড় পরিচ্ছন্ন করে সম্মানের সঙ্গে বিতরণ করা। খাদ্য, ওষুধ ও আশ্রয়ের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা। শুধু দান নয়, মানবিক আচরণও জরুরি। সাহায্য করতে গিয়ে কারো মর্যাদায় আঘাত করা মানবতার কাজ নয়; বরং সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে সাহায্য করাই প্রকৃত মানবতা।
মানবতার দীপ্তি জ্বালাই
শীত আমাদের জন্য ঋতুবদলের বার্তা, কিন্তু শীতার্তের জন্য এটি বেঁচে থাকার সংগ্রাম। সমাজে শীতার্ত মানুষের কষ্ট কমানো আমাদের নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব। আমরা যদি সামান্য সহমর্মিতা, ভালোবাসা ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করি, তবে পৃথিবী আরো একটু উষ্ণ, সুন্দর ও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, মানবতার হাতই সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের ছোট উদ্যোগ, ছোট দান বা সহায়তাই কারো জীবনে বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে। তাই আসুন, নিজের হৃদয়কে উষ্ণ করি, মানবতার দীপ্তি জ্বালাই এবং বলি, ‘শীতার্তের পাশে থাকুক মানবতার হাত।’
লেখক : মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর