একদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। ২০ ফেব্রুয়ারি। আমি বইমেলায়। মতি ভাইয়ের ফোন এলে। আনিস, কী করো?
বইমেলায় অটোগ্রাফ দিই।
বাসায় যাও। শাওয়ার নাও। এক কাপ কফি খাও। তারপর একটা কবিতা লেখো। কাল একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি একটা কবিতা প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপাব। তুমি লিখে দাও।
আমি বাসায় গেলাম। একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলাম সাড়ে নয়টার মধ্যে। মায়ের আঁচলে লুকোই মুখ। শেষ লাইনগুলো এ রকম:
‘আম্মার আঁচলে মুখ মুছে
আকাশে তাকিয়ে দেখি, সপ্তর্ষিমণ্ডলে আজও প্রশ্নচিহ্ন আঁকা।
শহীদেরা শুধোন সওয়াল, তোমরা কি আমাদের মতো নির্ভয়ে বলো?
শহীদেরা শুধোন সওয়াল, তোমরা কি আমাদের মতো নির্ভয়ে চলো?
আম্মার আঁচলে ফের লুকোতে চাই মুখ।
যদি পাই আজও কিছু রোদ্দুরের ঘ্রাণ।
যদি মোছা যায় কপালের বিন্দু বিন্দু নিরুত্তর ঘাম।’
শহীদেরা যদি প্রশ্ন করেন, আমরা কি কথা বলার সময় নির্ভয়ে কথা বলতে পারি? এর উত্তর তখনো ছিল ‘না’। এখনো বোধ হয় ‘না’। ভয় তো আছেই। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, সাহস মানে ভয়হীনতা নয়, ভয়কে জয় করার চেষ্টা করা।
মতি ভাই কবিতাটা পড়ে বলেছিলেন, তোমার মায়ের প্রতি একটা বিশেষ ভালোবাসা আছে। নানা লেখায় ওটা প্রকাশিত হয়।
আম্মা মারা গেলেন করোনার আগের বছর। আইসিইউতে ছিলেন। মারা যাবেন, সেটা আগের রাতেই আমরা বুঝে ফেলেছিলাম। পরের দিন আমার একটা লেখা দেওয়ার কথা। একজন তারকার সাক্ষাৎকার। আমি জানি, সকাল হওয়ার আগেই নিষ্ঠুর দুঃসংবাদটা আসবে। কাল আর আমি লিখতে পারব না। আমি রাত সাড়ে ১১টায় ফোনে তারকাকে ধরে ফেললাম। সাক্ষাৎকার নিলাম। রাত দুটোয় লেখাটা পাঠিয়ে শুতে গেলাম। ভোর পাঁচটায় ফোনটা এলে। আম্মা আর নাই।
সেই দিনটাও ছিল এমনি এক নভেম্বর। আমরা, সদ্য মা হারানো ভাইবোন, আমাদের পরিবার নিয়ে চললাম রংপুর। রংপুর গোরস্তানে আম্মাকে গোরে শুইয়ে ঢাকা ফিরে এলাম।
দুই দিন পর সোনারগাঁ হোটেলে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসে হাজির হলাম।
রবীন্দ্রনাথ থেকে সান্ত্বনা নিতে হয়—
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ…
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥’